
আচ্ছা, লিথপস বা লিভিং স্টোন – নামটা শুনেই কেমন যেন একটা কৌতূহল জাগে, তাই না? ভাবছেন, এ আবার কী জিনিস? এদের দেখতে অনেকটা ছোট পাথরের মতো, তাই এদের লিভিং স্টোন বা জীবন্ত পাথর বলা হয়। চলুন, আজকে আমরা জানবো ই রহস্যময় লিথপস বা লিভিং স্টোন সম্পর্কে ।
লিথপস (Lithops) বা লিভিং স্টোন
লিথপস হলো সাকুলেন্ট (succulent) প্রজাতির গাছ। এদের বিশেষত্ব হলো এরা দেখতে হুবহু পাথরের মতো। এই গাছগুলো মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার শুষ্ক ও পাথুরে অঞ্চলে দেখা যায়। পাথরের মতো দেখতে হওয়ার কারণে এরা সহজেই শিকারি প্রাণীদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। লিথপসের বৈজ্ঞানিক নামও Lithops, যার গ্রিক ভাষায় অর্থ “পাথরের মতো মুখ”। সত্যি, কী দারুণ নাম, তাই না?
আমার পছন্দের গাছ গুলোর মধ্যে এটি একটি। আমি যখন প্রথম বার এটি দেখেছিলাম তখন এটি আমার কাছে কিছুটা মানুঘের মাথার ব্রেইন এর মতো মনে হয়েছিলো। একটা অসাধরণ অনূভূতি ছিলো যখন , প্রথমবার এর মতো এই গাছটিতে দেখেছিলাম।
লিথপসের কিছু বৈশিষ্ট্য
চলো বন্ধুরা আমার এই গাছটি সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জেনে নেই।
- গঠন: লিথপস গাছগুলো সাধারণত এক বা একাধিক জোড়া পুরু পাতা দিয়ে গঠিত। পাতাগুলোর মাঝে একটি ফাটল থাকে, যেখান থেকে নতুন পাতা এবং ফুল জন্মায়।
- আকার: এরা খুবই ছোট আকারের হয়, মাটি থেকে সাধারণত ১ থেকে ২ ইঞ্চির বেশি বড় হয় না। তাই আপনার ডেস্কের জন্য এটি একটি পারফেক্ট পছন্দ হতে পারে।
- রং ও প্যাটার্ন: এদের রং এবং প্যাটার্ন বিভিন্ন প্রজাতির ওপর নির্ভর করে। সাধারণত ধূসর, বাদামি, সবুজ, লাল বা এই রংগুলোর মিশ্রণ দেখা যায়। পাথরের মতো ছোপ, ফাটল এবং রেখাচিত্র থাকার কারণে এদের আলাদা করে চেনা মুশকিল।
- ফুল: লিথপসের ফুল সাধারণত পাতার মাঝের ফাটল থেকে বের হয়। ফুলগুলো দেখতে ডেইজি বা গোলাপের মতো এবং সাদা বা হলুদ রঙের হয়। শীতকাল বা শরৎকালে এদের ফুল ফোটে।
কোথায় পাওয়া যায় এই লিভিং স্টোন?
লিথপস বা লিভিং স্টোন মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন শুষ্ক ও পাথুরে এলাকায় জন্মায়। যেমন – দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, বতসোয়ানা, এবং অ্যাঙ্গোলা। এই গাছগুলো শুষ্ক পরিবেশ, উঁচু তাপমাত্রা এবং কম বৃষ্টিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে। পাথুরে মাটি ও বালিতে এরা খুব ভালোভাবে বেড়ে ওঠে। এদের অনেক সময় মাটির নিচে আংশিক বা পুরোপুরি লুকানো অবস্থায় দেখা যায়।
তবে তুমি যদি বাংলাদেশ থেকে এই গাছটি কিনতে চাও , তাহলে তুমি প্রথমেই লোকাল নার্সারি গুলোতে দেখতে পারো। যদি সেখানে না পাও তবে বিভিন্ন ফেইসবুক পেইজে দেখতে পারো।
কীভাবে বাঁচে এই প্রতিকূল পরিবেশে?
ভাবছেন, এমন কঠিন পরিবেশে এরা কীভাবে বেঁচে থাকে? লিথপসের বেঁচে থাকার কৌশলগুলো সত্যিই অবাক করার মতো:
- এদের পাতাগুলো পুরু হওয়ার কারণে পানি ধরে রাখতে পারে, যা তাদের দীর্ঘ সময় ধরে বাঁচিয়ে রাখে।
- এদের মূল মাটির গভীরে প্রবেশ করে, ফলে মাটির নিচ থেকে পানি সংগ্রহ করতে সুবিধা হয়।
- পাথরের মতো দেখতে হওয়ায়, তৃণভোজী প্রাণীরা এদের গাছ মনে করে না, ফলে এরা বেঁচে যায়।
আসলেই বন্ধুরা , সৃষ্টিকর্তার কত সুন্দর সৃষ্টি।
লিথপসের বৃদ্ধি এবং জীবনকাল
লিথপস গাছ খুব ধীরে ধীরে বাড়ে।বছরে সাধারণত ২-৩ মিমি বা তার ও কম হতে পারে। এদের জীবনকাল প্রায় ৪০ থেকে ৫০ বছর বা তারও বেশি হতে পারে। প্রতি বছর নতুন পাতার একটি জোড়া জন্মায় পুরোনো পাতার মাঝখান থেকে, এবং পুরোনো পাতা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। লিথপসের একটি গভীর প্রধান মূল থাকে, যা মাটির গভীরে প্রবেশ করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে পানি সঞ্চয় করে।
বৈচিত্র্যময় লিথপস প্রজাতি
লিথপসের প্রায় ৩৭-৩৮টি প্রজাতি রয়েছে এবং এদের মধ্যে আকার, রঙ, প্যাটার্ন ও টেক্সচারের ভিন্নতা দেখা যায়। এদের মধ্যে Lithops optica rubra নামের প্রজাতিটি লাল বা লালচে বাদামী রঙের জন্য পরিচিত। এই গাছগুলো সাকুলেন্ট প্রেমীদের কাছে খুব জনপ্রিয়। লিথপস গাছের পাতার উপরের অংশে স্বচ্ছ “লিফ উইন্ডো” থাকে, যা গাছের ভিতরে আলো প্রবেশ করতে সাহায্য করে এবং ভেতরের সবুজ অংশে সালোকসংশ্লেষণ (photosynthesis) প্রক্রিয়াটি ভালোভাবে হয়।
লিথপস বা লিভিং স্টোন এর যত্ন
লিথপস বা লিভিং স্টোন এর যত্ন নেওয়া কিন্তু খুব সহজ, তবে কিছু জিনিস অবশ্যই মনে রাখতে হবে।
মাটি এবং পাত্র
লিথপসের জন্য ভালো পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা আছে, এমন মাটি ব্যবহার করতে হবে। অতিরিক্ত পানি দিলে গাছের পাতা ফেটে যেতে পারে। তাই বেলে মাটি বা পাথুরে মাটি ব্যবহার করা ভালো। টবের নিচে অবশ্যই ড্রেনেজ হোল থাকতে হবে, যাতে অতিরিক্ত পানি সহজেই বেরিয়ে যেতে পারে।
আলো এবং তাপমাত্রা
লিথপস গাছ ভালোবাসে উজ্জ্বল আলো। এদের প্রতিদিন অন্তত ৪-৫ ঘণ্টা সরাসরি সূর্যের আলোতে রাখা উচিত। তবে গ্রীষ্মকালে অতিরিক্ত তাপে এদের একটু ছায়ায় রাখতে পারেন। শীতকালে এদের ঘরের ভিতরে নিয়ে আসা ভালো, যেখানে তাপমাত্রা ১০-১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে।
জল দেওয়া
লিথপস গাছে খুব কম জল দিতে হয়। বছরে কয়েকবার জল দিলেই যথেষ্ট। গ্রীষ্মকালে এরা সুপ্ত অবস্থায় থাকে, তাই এই সময় জল দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। মাটি পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে তবেই জল দিন। অতিরিক্ত জল দিলে গাছের গোড়া পচে যেতে পারে। তবে শীত কালে সাধারণত এদের বৃদ্ধির মূল সময়। তাই এই মাসে ৩/৪ বার পানি দিতে হবে।
সার প্রয়োগ
লিথপসে তেমন সার দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে, যদি দিতে চান, তবে খুব সামান্য পরিমাণে ব্যালেন্সড সার ব্যবহার করতে পারেন।
আরো পড়ুন : পর্তুলিকা বনসাই করার নিয়ম
অন্যান্য যত্ন
- নিয়মিতভাবে গাছের শুকনো পাতা সরিয়ে ফেলুন।
- গাছে কোনো রোগ বা পোকা লাগলে দ্রুত ব্যবস্থা নিন।
- টবে অতিরিক্ত লিথপস থাকলে , গাছগুলোকে আলাদা করে দিন।
বন্ধুরা লিভিং স্টোন বা লিথপস এর যত্নের বিষয়ে আমার যতটুকু ধারণা ছিলো ততটুকুই তোমাদের মাঝে শেয়ার করলাম। তোমাদের যদি কোথাও বুঝতে অসুবিধা হয় তবে কমেন্ট করতে পারো।
উপসংহার
লিথপস বা লিভিং স্টোন নিঃসন্দেহে একটি অসাধারণ গাছ। এর ব্যতিক্রমী চেহারা এবং সহজ পরিচর্যা একে জনপ্রিয় করে তুলেছে। আপনিও যদি আপনার ঘর বা বাগানকে একটু অন্যরকম সাজাতে চান, তাহলে লিথপস হতে পারে আপনার জন্য একটি দারুণ পছন্দ। এই গাছের সঠিক যত্ন নিলে এটি আপনার জীবনে অনেক আনন্দ নিয়ে আসবে।
লিথপস নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
না, লিথপস বিষাক্ত নয়। এটি মানুষ এবং পশু উভয়ের জন্য নিরাপদ।
অতিরিক্ত জল দেওয়া অথবা কম আলো পাওয়ার কারণে লিথপসের পাতা কুঁচকে যেতে পারে।
পর্যাপ্ত আলো এবং সঠিক পরিচর্যার অভাবে লিথপসে ফুল নাও ফুটতে পারে।
হ্যাঁ, লিথপস ইনডোর প্ল্যান্ট হিসেবে ভালো, তবে পর্যাপ্ত আলো নিশ্চিত করতে হবে।
সঠিক পরিচর্যা করলে লিথপস ৪০ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে বা তার ও বেশিদিন বাচতে পারে।
Leave a Reply